স্বদেশ ডেস্ক: রাজধানীর নবাবপুর রোডে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বরাদ্দকৃত তিনতলা বাড়ি দখলকারী দুই ভাই জাবেদ ও আবেদের আরও অনেক কুকীর্তির খবর পাওয়া গেছে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকাতে তারা ইতিপূর্বে আরও ৫টি বাড়ি দখল করেছেন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে। সে সময়ও লালবাগ বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা ঘুষ প্রদান করা হয়েছিল। দখলকৃত সে সব বাড়িতে কয়েক বছর আগেই নতুন নতুন ভবন নির্মাণের পর এখন কোটি কোটি টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
আবেদ ও জাবেদের অতীত বলছে, তাদের চরিত্র ‘দুধের মাছির’ মতো। বিএনপির শাসনামলে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন দুজন। খোকা ও তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টুর প্রভাবকে পুঁজি করে জাল দলিলপত্র তৈরি করে অর্পিত সম্পত্তিও দখল করতেন জাবেদ ও আবেদ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুজন তাদের নামের আগে ‘শেখ’ শব্দটি যুক্ত করেন; বনে যান নব্য আওয়ামী লীগার এবং চালিয়ে যেতে থাকেন পুরনো অপকর্ম।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের চাচাতো ভাই ও নবাবপুরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সাজেদ আহমেদ ব্যাপারীর নাম ভাঙিয়ে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক খানের পরিবারের নামে বরাদ্দকৃত জমির তিনতলা বাড়ি ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ করছেন জাবেদ-আবেদ। আর এ হীনকর্মে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব পেতে তারা ৩ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান পেয়েছেন ২ কোটি এবং বংশাল থানার তৎকালীন ওসি শাহিদুর রহমান পেয়েছেন এক কোটি টাকা। ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানকে অবশ্য এ কা-ের জেরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জাবেদ-আবেদ দুই ভাইয়ের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়। শুধু নবাবপুরেই ঢাকা জেলা পরিষদের ইজারাকৃত এবং অর্পিত সম্পত্তি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে তারা ৫টি মার্কেট করেছেন বলে জোর অভিযোগ রয়েছে।
নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক খানের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িতে অবস্থিত মাসুদা করপোরেশন নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি দখলে নিতে জাবেদ-আবেদ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা বাধা দিই। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মার্কেট বন্ধের দিন ছিল। সেদিন সন্ধ্যার পর ওই মার্কেটের পাশে অবস্থিত জাবেদ-আবেদের গাউসিয়া মার্কেট কাম আবাসিক ভবনে উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজানো হয়। গান-বাজনার আড়ালে শতাধিক শ্রমিক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার মার্কেটটি ভেঙে চুরমার করা হয়।
আওলাদ হোসেন বলেন, খবর পেয়ে রাতেই আমরা তখনকার ডিসি ইব্রাহিম খানকে ফোন দিই। ডিসি জবাব দেন, তার বিভাগীয় পরীক্ষা আছে। এ কারণে তিনি ব্যস্ত আছেন। আবার ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে পুলিশ দুর্বল মামলা রুজু করায় একদিনের মাথায় তারা জামিনও পেয়ে যান। তিনি বলেন, আমরা এমন পুলিশ কর্মকর্তা ও দলের প্রভাব কাজে লাগানো অপকর্মকারীদের বিচার চাই।
নবাবপুরের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, জেলা পরিষদের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় অর্পিত সম্পত্তিতে জাল দলিল তৈরি করতেন জাবেদ-আবেদ। বিরোধপূর্ণ জমির এক পক্ষকে ম্যানেজ করে বাকিদের জমি দখল করে নিতেন। এভাবে ২৩৪, ২৩৫, ২৩৫ সি নবাবপুর রোডের জমির বয়লার মার্কেট; ৫০ নবেন্দ্রনাথ বসাক লেনের জান্নাত প্লাজা মার্কেট; ২১৯-২২০ নবাবপুর রোডের গাউসিয়া মার্কেট এবং ৯৫ রহিমা প্লাজা গড়েছেন দুই ভাই।
প্রতিটি প্লট দখল ও মার্কেট নির্মাণ নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। কিন্তু আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশ নিয়ে তারা ভবনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যান। এ এলাকায় প্রতি কাঠা জমির বাজারমূল্য দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। প্রতিটি মার্কেট থেকে বছরে ভাড়া উঠছে কোটি কোটি টাকা। অবৈধ এ আয়ের একটি অংশ পাঠানো হচ্ছে পুলিশসহ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে।
ওই এলাকার ছয়তলা ভবন জাবিন প্লাজার চারতলায় রয়েছে দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান ‘ফিউচার শাইন প্রপার্টিজ’। এটি বহুতল ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। আর ফিউচার শাইন মরিয়ম প্লাজা নামে ঠিক করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের বরাদ্দকৃত জমিতে। সর্বশেষ জানা গেছে, এ প্লটটির নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে আনসারদের পাহারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মেয়র সাঈদ খোকনের চাচাতো ভাই সাজেদ আহমেদ ব্যাপারী ও বংশালের এমপি হাজী সেলিমের নাম ভাঙিয়ে দুই ভাই সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা পরিষদের সঙ্গে নুরুল হক নুরু মিয়ার মামলা চলা ২২২ নবাবপুর রোডের সাড়ে ৮ কাঠা জমিও জবরদস্তি দখলে নিয়েছেন জাবেদ-আবেদ। ভুক্তভোগী নুরু মিয়া জানান, তার বাবা আবদুল্লাহ মিয়া ১৯৫২ সালে অর্পিত সম্পত্তি কিনেছেন। সেখানে ২ তলা ভবনে তারা ৭ ভাই ও ৩ বোনের পরিবার বসবাসসহ ভাড়াও দিয়েছেন। এর পর ওই সাড়ে ৮ কাঠা জমির মালিকানা নিয়ে ১৯৮০ সাল থেকে জেলা পরিষদের সঙ্গে তাদের মামলা চলছে। মামলার প্রতিটি ধাপে উচ্চ আদালত পর্যন্ত তারা রায় পান। কিন্তু কয়েক বছর আগে হঠাৎ জাবেদ-আবেদ একইভাবে বাড়ি ভেঙে দখল করে নেন। তখনকার একজন প্রভাবশালী ও আলোচিত পুলিশের ডিসির কাছে গেলে তিনি উল্টো ফ্ল্যাট বা নগদ টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলেন। এর পর ভাগ্নেদের এমপি হাজী সেলিমের কাছে গেলেও সুবিচার পাইনি।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র শামসুল হাসান খান আবির আমাদের সময়কে বলেন, জাবেদ-আবেদের দখলদারিত্বে পুলিশের ডিসি ছাড়াও ডিসি অফিসের লোকজন জড়িত। সেই সুযোগ নিয়ে জাবেদ আমাকে এর আগে বহুবার হুমকি দেন। এখন আমি সরকারের কাছে জমির দখল, ভেঙে ফেলার ক্ষতিপূরণ ও লুটপাটে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।
অভিযোগের বিষয়ে আবেদ ও জাবেদের বক্তব্য জানতে বারবার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।